হাদীসের উপর বিশ্বাস: সহীহ, যইফ, জাল কি গোলক ধাঁধা ?

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে, হাদীসের সহীহ/ জাল কার কথার উপর ভিত্তি করে বিশ্বাস করবো? আর এগুলো কতোটা সত্য?

আর এই প্রশ্ন আমার মধ্যেও ছিলো। তবে আমি যতটুকু জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি তার থেকেই বলার চেষ্টা করি। তবে এর পূর্বে খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাজ্গীর এর কিছু কথা:

"এখানে সাধারণ পাঠকের অনুধাবনের জন্য সহজ ব্যখ্যার চেষ্টা করব। মনে করুন একজন বিচারক একজন হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনীত সাক্ষ্য প্রমাণাদি নিরীক্ষা করলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, সে পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় এক ব্যক্তিকে খুন করেছে। প্রদত্ত সাক্ষ্য প্রমাণাদির ভিত্তিতে তিনি সাম্ভাব্য ৪ প্রকার রায় প্রদান করতে পারেন: (ক) মৃত্যুদন্ড (খ) যাবজ্জীবন কারাদন্ড (গ) কয়েক বছরের কারাদন্ড (ঘ) বেকসুর খালাস। মোটামুটিভাবে হাদীসের নির্ভরতার ক্ষেত্রেও এ পর্যায়গুলো রয়েছে।"


অর্থাৎ, হাদীস- সহীহ, হাসান, যইফ, জাল হতে পারে।

আমি শুধু আলোচনা করতে চাচ্ছি, সহীহ হাদীস গ্রহণে আমি কি করতে পারি ? (ভূল হলে আমার জ্ঞানের স্বল্পতা, আমার চেয়ে ভালো জ্ঞান অনেকেই রাখেন)

১. সহীহ বা বিশুদ্ধ হাদীস:
মুহাদ্দীসগণের পরিভাষায় যে হাদীসের মধ্যে ৫ টি শর্তবিদ্যমান তাকে সহীহ হাদীস বলা হয়: (১) 'আদালত'- হাদীসের সকল রাবী পরিপূর্ণ সৎ বলে প্রমাণিত, (২) 'যাবত'- সকল রাবীর নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা পূর্ণরূপে প্রমাণিত, (৩) 'ইত্তিসাল'- সনদের প্রত্যেক রাবী তার উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে হাদীস শুনেছেন বলে প্রমাণিত (৪) 'শুযূয মূক্তি'- হাদীসটি অন্যান্য প্রামাণ্য বর্ণনার বিপরীত নয় বলে প্রমাণিত এবং (৫) 'ইল্লাত মুক্তি'- হাদীসটির মধ্যে সুক্ষ্ম কোন সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি নেই বলে প্রমাণিত।

প্রথম তিনটি শর্ত সনদ কেন্দ্রিক ও শেষের দুটি শর্ত মূলত অর্থ কেন্দ্রিক। এগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা অপ্রাসঙ্গিক। তবে সাধারণ পাঠকের জন্য আমরা বলতে পারে যে, প্রদত্ত সাক্ষ্য- প্রমাণাদির বিষয়ে যতটুকু নিশ্চিয়তা (নারপেক্ষভাবে) অনুভব করলে একজন বিচারক মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিতে পারেন, বর্ণিত হাদিসটি সত্যিই রাসূল (সা:) বলেছেন বলে অনুরূপভাবে নিশ্চিত হতে পারলে মুহাদ্দীসগণ তাকে 'সহীহ' বা 'বিশুদ্ধ হাদীস' বলে গণ্য করেন।

২. 'হাসান' অর্থাৎ 'সুন্দর' বা গ্রহণযোগ্য হাদীস:
মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় হাসান হাদীসের মধ্যেও উপর্যুক্ত ৫টি শর্তের বিদ্যমানতা অপরিহার্য। তবে দ্বিতীয় শর্তের ক্ষেত্রে যদি সামান্য দুর্বলতা দেখা যায় তবে হাদীসটিকে 'হাসান' বলা হয়। অর্থাৎ হাদীসের সনদের রাবীগণ ব্যাক্তিগতভাবে সৎ, প্রত্যেকে হাদীসটি উর্ধ্বতন রাবী থেকে স্বকর্ণে শুনেছেন বলে প্রমাণিত, হাদীসটি 'শুযূয' ও 'ইল্লাত' মুক্ত। তবে সনদের কোন রাবীর 'নির্ভুল বর্ণনার ক্ষমতা' বা 'যাবত' কিছুটা দুর্বল বলে বুঝা যায়। তাঁর বর্ণিত হাদীসের মধ্যে কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়। এরূপ 'রাবী'র' বর্ণিত হাদীস 'হাসান' বলে গণ্য।

৩. 'যয়ীফ' বা দুর্বল হাদীস:
যে 'হাদীসের' মধ্যে হাসান হাদীসের শর্তগুলোর কোনো একটি শর্ত অবিদ্যমান দেখা যায়, মুহাদ্দিসগণের পরিভাষায় তাকে 'যয়ীফ' হাদীস বলা হয়। অর্থাৎ রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতি ঘাটতি, সনদের মধ্যে কোন একজন রাবী তাঁর উর্ধ্বতন রাবী থেকে সরাসরি ও স্বকর্ণে হাদিসটি শুনেননি বলে প্রমাণিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, হাদীসটির মধ্যে 'শুযূয' অথবা 'ইল্লাত' বিদ্যমান থাকা.... ইত্যাদি যে কোন একটি বিষয় কোন হাদীসের মধ্যে থাকলে হাদীসটি 'যয়ীফ' বলে গণ্য।

শর্ত পাঁচটির ভিত্তীতে 'যয়ীফ' হাদীসকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন মুহাদ্দিসগণ। তবে আমরা বুঝতে পারি যে, কোন হাদীসকে 'যয়ীফ' বলে গণ্য করার অর্থ হলো, হাদিসটি রাসূল (সা:) এর কথা নাও হতে পারে অর্থাৎ মিথ্যা হতে পারে। আর বর্ণনাকারীর দুর্বলতা বুঝাতে মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেমন: দুর্বল, কিছুই না, মূল্যহীন, অজ্ঞাত পরিচয়, জঘন্য উল্টোপাল্টা বর্ণনাকারী, পরিত্যক্ত, মিথ্যাবাদী, ইত্যাদি।

'যয়ীফ' বা দুর্বল হাদীসের দুর্বলতার তিনটি পর্যায় রয়েছ:
(ক) কিছুটা দুর্বল:
বর্ণনাকারী ভুল বলেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়, কারণ তিনি যতগুলো হাদীস বর্ণনা করেছেন তার মধ্যে বেশ কিছু ভুল রয়েছে। তবে তিনি ইচ্ছা করে ভুল বলতেন না বলেই প্মাণিত। এরূপ যয়ীফ হাদীস যদি অন্য এক বা একাধিক পর্যায়ে 'কিছুটা' যয়ীফ সূত্রে বর্ণিত হয় তাহলে তা 'হাসান' বা গ্রহণযোগ্য হাদীস বলে গণ্য হয়।

(খ) অত্যন্ত দুর্বল:
এরূপ হাদীসের বর্ণনাকারীর সকল হাদীস তুলনামূলক নিরীক্ষা করে যদি প্রমাণিত হয় যে, তাঁর বর্ণিত অধিকাংশ বা প্রায় সকল হাদীসই অগণিত ভুলে ভরা, যে ধরনের ভুল সাধারণত অনিচ্ছাকৃতভাবে হয় তার চেয়েও মারাত্মক ভুল, তবে তার বর্ণিত হাদীসটি 'পরিত্যক্ত', একেবারে অগ্রহণযোগ্য বা অত্যন্ত দুর্বল বলে গণ্য করা হবে। এরূপ দুর্বল হাদীস অনুরূপভাবে অন্য দুর্বল সূত্রে বর্ণিত হলেও তা গ্রহণযোগ্য নয়।

(গ) মাউযূ বা বানোয়াট হাদীস:
যদি প্রমাণিত হয় যে এরূপ দুর্বল হাদস বর্ণনাকারী ইচ্ছাকৃতভাবে রাসূল (সা:) এর নামে প্রচার করতেন বা ইচ্ছাকৃতভাবে হাদীসের সূত্র বা মূল বাক্যের মধ্যে কমবেশি করতেন, তবে তার বর্ণিত হাদীস কে 'মাউযূ' বা 'বানোয়াট' বলে। এইসব হাদীস জগণ্যতম দুর্বল হাদীস।


১. স্বভাবিক অবস্হায় আমরা প্রসিদ্ধ ছয়টি কিতাব (সহীহ বুখারী, মুসলিম; সুনানে তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ, নাসায়ী) এর উপর আস্হা রাখতে পারি । এক্ষেত্রে বুখারী, মুসলিম এর সহীহ হওয়া সম্পর্কে প্রায় সকল বিদ্বানগণ একমত। আর বাকি চারটি কিতাবের উপরও আস্হা রাখতে পারেন যতক্ষণ না কোন পরস্পর বিপরীত হাদীস পান। আর যদি পরস্পর বিপরীত কিছু পান তাহলে কোন আলেমের নিকট ধারস্হ হওয়াই উত্তম।

২. উপরোক্ত ছয়টি গ্রন্হ ব্যতীতও বহু গ্রন্হ (মুসনাদে আহমদ, আত তাবারানী, দারেমী, ইবনু খুযাইমাহ, ইবনু হিব্বান, মুয়াত্তা ইবনু মালিক, ....) রয়েছে যেখানে বহু সহীহ হাদীস রয়েছে।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটা,তা হলো- কার কথার উপর বিশ্বাস করে আমি এইসব গ্রন্হের হাদীসকে সহীহ হিসেবে বিশ্বাস করবো?

এই প্রশ্নের উত্তর জানার পূর্বে আমাদের জানতে হবে, আসলে কেউ মিথ্যা/জাল হাদীস বলবে কি না ?

"সামুরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আমার তরফ থেকে কোন হাদীস বর্ণনা করে অথচ সে জানে যে, তা মিথ্যা, তবে সে দুই মিথ্যুকের একজন" (বুখারী, মুসলিম, রিয়াযুস স্বলিহীন: ১/১৫৫৫; অধ্যায় ১৭)

রাসূল (সা.) আরো বলেন, যেমন আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে জাহান্নামে তার বাসস্হা বানিয়ে নিক। (বুখারী)

অর্থাৎ রাসূল (সা.) এর উপর মিথ্যারূপ করা হবে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এবং তাদের ব্যাপারে অগ্রীম হুঁশিয়ারও দিয়ে গেছেন। তাই জাল হাদীস সৃষ্টি হবে তা ইসলাম ই বলে। তাহলে এখন আলোচনার বিষয় সহীহ কে বলবে?

আল্লাহ তাঁর দ্বীনকে সমুন্নত রাখার জন্য রাসূল (সা.) এর পরও বহু জ্ঞানী লোক কে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যাদের উদ্দেশ্যই ছিলো রাসূল (সা.) এর দেখানো পথে মানুষকে ডাকা এবং তা সঠিক ভাবে উপস্হাপন করা। আর এই দায়িত্ব সাহাবাদের (রা.) আমল থেকে বর্তমানে পালন করছেন বহু বিদ্বান। হয়তো কালের আবর্তনে জ্ঞানী লোকের সংখ্যা কমেছে কিন্তু চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। তাই তাদের উপর আস্হা রেখেই খুজে নিতে হবে কোনটা সহীহ, কোনটা যইফ, কোনটা জাল।

তবে আমাদের অনেকের পক্ষেই যযেহেতু পূর্বেকার ঈমামগণের সকল মত জানা সম্ভব না, তাই এখনকার কোনো জ্ঞানী ব্যক্তির নিকট থেকেই জানার চেষ্টা করতে হবে। আর কোনো ব্যক্তির জ্ঞান হিসাব করতে গিয়ে অন্তত তাঁর আক্বীদা ও উদ্দেশ্য জেনে নেওয়া আবশ্যকীয়। কারণ শিয়া, খারেজী, সুফী ব্যক্তি বিদ্বান হলেও পরিতাজ্য। কারণ তাদের আক্বীদাতেই গন্ডগোল।

তাই আমাদেরকে কোনো সত্যিকার বিদ্বান খুজতে হলেও ইসলামের নূন্যতম জ্ঞান (ঈমান ও আক্বীদা ঠিক) রাখা আবশ্যক। আর এর জন্য আল্লাহর নিকট সাহায্য চাওয়া ও নিজে চেষ্টা করতে হবে।

(আল্লাহ আমাদের জন্য সহজ করুন)

Post a Comment

Previous Post Next Post