আবু ত্বালিবের নিকট কুরাইশ প্রতিনিধি দল


ইবনে ইসহাক্ব বলেন যে, কুরাইশ গোত্রের কয়েকজন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি একত্র হয়ে আবু ত্বালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আবু ত্বালিব আপনার ভ্রাতুষ্পুত্র আমাদের দেব-দেবীগণকে গালিগালাজ করছেন, আমাদের ধর্মের নিন্দা করছেন, আমাদেরকে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার-বিবেকহীন, মূর্খ বলেছেন এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণকে ধর্মভ্রষ্ট বলেছেন। অতএব, হয় আপনি তাঁকে এ জাতীয় কাজকর্ম থেকে বিরত রাখুন নতুবা আমাদের এবং তাঁর মধ্য থেকে আপনি দূরে সরে যান। কারণ, আপনিও আমাদের মতই তাঁর বক্তব্য মতে ভিন্নধর্মের অনুসারী। তাঁর ব্যাপারে আমরাই আপনার জন্য যথেষ্ট হব।

এর জবাবে আবু ত্বালিব অত্যন্ত ঠান্ডা মেজাজে কিছু কথাবার্তা বলে তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বিদায় করলেন। এ প্রেক্ষিতে তারা ফিরে চলে গেলেন। এ দিকে রাসূলুল্লাহ (সা) পূর্ণোদ্যমে তাঁর প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে থাকলেন। দীনের দাওয়াত প্রচার করতে থাকলেন এবং সেদিকে লোকদেরকে আহ্বান জানাতে থাকলেন।

এদিকে কুরাইশগণও বেশি দেরি করলেন না যখন দেখলেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা:) তাঁর কাজ পূর্ণমাত্রায় চালিয়ে যাচ্ছেনই, বরং তাঁর দাওয়াতী তৎপড়তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন । তাই পূর্বের চেয়ে আরো ক্রোধ ও গরম মেজাজ নিয়ে আবু ত্বালিবের নিকট পুনরায় আগমন করলেন ।

আবু ত্বালিবের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কুরাইশ প্রধানগণ আবু ত্বালিবের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, হে আবু ত্বালিব! আপনি আমাদের মাঝে মান-মর্যাদার অধিকারী একজন বয়স্ক ব্যক্তি। আমরা ইতোপূর্বে আপনার নিকট আবেদন করেছিলাম যে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রকে আমাদের ধর্ম সম্পর্কে নিন্দাবাদ করা থেকে বিরত রাখুন। কিন্তু আপনি তা করেন নাই। আপনি মনে রাখবেন, আমরা এটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারছিনা যে আমাদের পিতা, পিতামহ এবং পূর্ব পুরষদের গালিগালাজ করা হোক। আমরা আবারও আপনাকে অনুরোধ করছি হয় আপনি তাকে সে সব থেকে নিবৃত্ত রাখুন, নচেৎ আমাদের দু'দলের মধ্যে এক দল ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ বিগ্রহ চলতেই থাকবে ।

কুরাইশ প্রধানগণের এমন কঠিন বাক্য বিনিময় এবং আস্ফালনে আবু ত্বালিব অত্যন্ত বিচলিত হয়ে পড়লেন। তিনি সেই মূহুর্তে তাঁর কর্তব্য স্থির করতে না পেরে নবী কারীম (সা:) কে ডেকে পাঠালেন। চাচার আহ্বানে নবী কারীম (সা:) সেখানে উপস্থিত হলে আবু ত্বালিব তাঁর নিকট কুরাইশ প্রধানগণের আলোচনা এবং আচরণ সম্পর্কে সবিস্তার বর্ণনা করার পর তাঁকে লক্ষ্য করে বললেন, বাবা! একটু বিচার বিবেচনা করে কাজ করো। যে ভার বহন করার শক্তি আমার নেই সে ভার আমার উপর চাপিয়ে দিও না।

রাসূলুল্লাহ (সা:) ধারণা করলেন, মানবকুলের মধ্যে তাঁর একমাত্র আশ্রয়দাতা ও সহায় চাচাও বোধ হয় আজ থেকে তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করলেন এবং তাঁকে সাহায্য দানের ব্যাপারে তিনিও বোধ হয় দুর্বল হয়ে পড়লেন । তবুও আল্লাহ তা'আলার উপর অবিচল আস্থা রেখে তিনি বললেন,

'চাচাজান, আল্লাহর শপথ! যদি এরা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চাঁদ এনে দেয় তবুও শাশ্বত এ মহা সত্য প্রচার সংক্রান্ত আমার কর্তব্য থেকে এক মূহুর্তের জন্যও আমি বিচ্যুত হব না । এ মহামহিম কার্যে হয় আল্লাহ আমাকে জয়যুক্ত করবেন, না হয় আমি ধ্বংস হয়ে যাব । কিন্তু চাচাজান! আপনি অবশ্যই জানবেন যে, মহাম্মদ (সা) কখনোই এ কর্তব্য থেকে বিচ্যুত হবে না।'

স্বজাতীয় এবং স্বগোত্রীয় লোকজনদের নির্বুদ্ধিতা, হঠকারিতা এবং পাপাচারে ব্যথিত হৃদয় নাবী (সা:) এর নয়নযুগলকে বাষ্পাচ্ছন্ন করে তুলল। তিনি সু-স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করলেন যে ভবিষ্যতের দিনগুলো তাঁর জন্য আরো বেশি কঠিন হবে এবং সাহসীকতার সাথে তা মোকাবালা করতে হবে। এমন এক মানসিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে তিনি চাচা আবু ত্বালিবের সম্মুখ থেকে বেরিয়ে এলেন।

তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রের এ অসহায়ত্ব ও মানসিক অশান্তিতে আবু ত্বালিবের মন কেঁদে উঠল। পরক্ষণেই তিনি তাঁকে পুনরায় ডেকে পাঠালেন। যখন নাবী কারীম (সা:) তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হলেন তখন তিনি তাঁকে পুনরায় সম্বোধন করে বললেন: 'প্রিয়তম ভ্রাতুষ্পুত্র! নির্দ্ধিধায় নিজ কর্তব্য পালন করে যাও । আল্লাহর কসম করে বলছি আমি কোন অবস্থাতেই তোমাকে পরিত্যাগ করব না।


- আর-রাহীকুল মাখতুম

Post a Comment