তিন বছর গোপনে ইসলাম প্রচার

সূরা মুদ্দাসসিরের প্রথম থেকে সপ্তম আয়াত পর্যন্ত-

১. ওহে বস্ত্র আবৃত (ব্যক্তি)! ২. ওঠ, (মানুষকে) সতর্ক কর। ৩. আর তোমার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর । ৪. তোমার পোশাক পরিচ্ছদ পবিত্র রাখ। ৫. (যাবতীয়) অপিবত্রতা থেকে দূরে থাক। ৬. (কারো প্রতি) অনুগ্রহ করো না অধিক পাওয়ার উদ্দেশ্যে। ৭. তোমার প্রতিপালকের (সন্তুষ্টির) জন্য ধৈর্য ধর।'

উপরোক্ত আয়াতসমূহ নাযিল হওয়ার পর রাসূল (সা.) পথহারা মানুষদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেওয়ার কাজ শুরু করলেন এমন অবস্হায় যে, তাঁর জাতি কুরাইশদের মূর্তি ও প্রতিমার পূজা-আর্চনা ব্যতীত কোন দ্বীন ছিলো না। তাদের সঠিক কোন হজ্জ ছিলো না, তবে তারা হজ্জ করতো যেভাবে তাদের পিতৃপুরুষদেরকে দেখেছে। তাদের আত্মমর্যাদা ও বংশগৌরব ব্যতীত কোন সৎচরিত্র ছিলো না। তা সত্ত্বেও মক্কা ছিলো আরববাসীগণের ধর্মীয় চেতনার কেন্দ্রস্হল। এ জন্যই দূরবর্তী স্হানের তুলনায় মক্কায় সংস্কারমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়নের ব্যাপারটি ছিল অনেক বেশি কঠিন ও কষ্টকর । এ অবস্হার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক পর্যায়ে মক্কায় প্রচার ও দাওয়াতের কাজকর্ম সঙ্গোপনে করার প্রয়োজন ছিলো।

আর এটা খুব স্বভাবিক ও সঙ্গত কথা যে যারা রাসূল (সা.) এর সব চেয়ে কাছের, সব চেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং সব চেয়ে নির্ভরযোগ্য ছিলেন, সর্বপ্রথম তিনি তাদের নিকট ইসলামের দাওয়াত পেশ করেছিলেন। এ দলের মধ্যে ছিলেন পরিবারের লোকজন, ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব। অধিকন্ত, প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ঐ সকল লোক কে সত্যের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন যাদের মুখমন্ডল কল্যাণ এবং সত্য-প্রীতির আভাষ ছিল সুস্পষ্ট। তাছাড়া যাঁরা নাবী (সা.) এর সততা, সত্যবাদিতা এবং পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সুবিদিত ছিলেন এবং এ কারণে প্রথম আহ্বানে সাড়া দিয়ে তারা ইসলাম কবুল করেন এবং প্রথম মুসলিম হওয়ার এক দুর্লভ গৌরব অর্জন করেন। এদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন উম্মুল মু'মিনীন খাদীজাতুল কুবরা (রা.), তার স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ক্রীতদাস যায়দ বিন হারিসাহ, তার চাচাত ভাই আলী বিন আবূ তালিব (রা.) এবং তাঁর সাওর গুহার সঙ্গী আবু বকর সিদ্দীক (রা.)। এরা সকলে প্রথম দিনেই মুসলিম হয়েছিলেন।

তারপর আবু বকর (রা.) ইসলাম প্রচারে বেশ তৎপর হয়ে উঠেন। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়, কোমল স্বভাব, পছন্দনীয় অভ্যাসের অধিকারী, সচ্চরিত্র এবং দরাজ দিল ব্যক্তি ছিলেন । তার দানশীলতা, দূরদর্শিতা, ব্যবসা-বানিজ্য এবং সৎ সাহচর্যের কারণে তাঁর নিকট লোকজনের গমনাগমন প্রায় সময় লেগেই থাকতো। আর তাদের মধ্যে এবং আশেপাশে বসবাসকারীগণের মধ্যে যাঁকে বিশ্বাসযোগ্য মনে করতেন তার সামনেই ইসলামের দাওয়াত পেশ করতেন। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় উসমান (রা.), জুবাইর (রা.), আব্দুর রহমান (রা.) বিন আওফ, সা'দ বিন আবী ওয়াক্কাস (রা.) এবং তালহা বিন উবায়দুল্লাহ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। এ মহা সম্মানিত ব্যক্তবর্গই হচ্ছেন প্রথম মুসলিম জনগোষ্ঠী।

প্রাথমিক অবস্হায় যারা ইসলাম গ্রহণ করেন, বিলাল হাবশী (রা.) ও ছিলেন সেই দলের অন্তর্ভুক্ত। এরপর ইসলাম গ্রহণ করেন আবূ উবায়দাহ আমর বিন জাররাহ (রা.), আবূ সালামাহ (রা.) সহ অনেকে।

উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও প্রাথমিক পর্যায়ের মুসলমান মহিলাদের মধ্যে রয়েছেন, উম্মু আইমান বারাকাত হাবশী, উম্মুল ফযল লুবাবাতুল কুবরা বিনতে হারিস হিলালিয়া, আসমা বিনতে আবু বকর সিদ্দীক (রা.)।

উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারী হিসেবে প্রসিদ্ধ । বিভিন্নতাবে অনুসন্ধান ও গবেষণার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে, প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণকারীর গুণে গুণান্বিতদের সংখ্যা পুরুষ-মহিলা মিলে ৩৩০ জন। তারা সকলেই প্রকাশ্য দাওয়াত চালুর পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন নাকি কেউ কেউ বিলম্ব করেছিলেন তা অকাট্যভাবে জানা যায় নি।

প্রাথমিক পর্যায়ে যেসকল আয়াত নাযিল হয়েছিল তাতে নামাজের নির্দেশনা বিদ্যমান ছিল। ইবনে হাজার বলেন যে, নাবী কারীম (সা.) এবং তাঁর সাহাবাগণ (রা.) মিরাজের ঘটনার পূর্বে অবশ্যই নামাজ পড়তেন। তবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার পূর্বে নামাজ ফরজ ছিলো কি ছিলো না সে ব্যপারে মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলে থাকেন যে, সূর্য উদয় এবং অস্ত যাওয়ার পূর্বে একটি করে সালাত ফরজ ছিলো।

ইবনে হিশামের এক বর্ণনায় রয়েছে যে, নাবী কারীম (সা.) এবং সাহাবীগণ (রা.) সালাতের সময় ঘাঁটিতে চলে যেতেন এবং গোত্রীয় লোকজনের দৃষ্টির আড়ালে গোপন সালাত আদায় করতেন।

প্রথম পর্যায়ের মুসলমানগণ এসব ইবাদাত করতেন। সালাত সংশ্লিষ্ট ইবাদাত ব্যতীত অন্য কোন ইবাদাত বা আদেশ নিষেধের কথা জানা যায় না। সে সময়কার ওহীতে মূলত সে সব বিষয়ে বর্ণিত হয় যা বিভিন্নভাবে তাওহীদের বর্ণনা, তাদেরকে আত্মশুদ্ধির প্রতি উৎসাহিতকরণ, উন্নত চরিত্র গঠনে উদ্বুদ্ধকরণ, জান্নাত-জাহান্নামের বর্ণনা যেন তা চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।

এভাবে তিন বছর অতিক্রান্ত হয় কিন্তু ইসলামের দাওয়াত গুটিকয়েকর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। রাসূল (সা.) তা লোকসমাজে প্রকাশ করতেন না। তবে কুরাইশরা ইসলামের খবর জানতো ও মক্কাতে ইসলামের কথা ছড়িয়ে পড়ে এবং লোকসমাজে এর মৃদু গুঞ্জন চলতে থাকে। আবার কেউ একে ঘৃণাও করতো এবং মুমিনদের সাথে শত্রুতা ভাব দেখাতো। তবে সামনা সামনি কিছু বলতো না যতক্ষণ পর্যন্ত না রাসূল (সা.) তাদের ভিত্তিহীন ও মনগড়া ইলাহ মূর্তিসমূহের সমালোচনা না করতেন।

সূত্রঃ আর্-রাহীকুল মাখতুম

Post a Comment