আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রা) : একজন বিনয়ী মানুষের কথা


আব্দুল্লাহ ইবন উমার। পিতা উমার ইবনুল খাত্তাব, মাতা যয়নাব। সঠিক বর্ণনা মতে হিজরী তৃতীয় সনে উহুদ যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল চৌদ্দ বছর। এই হিসাবে নবুয়াতের দ্বিতীয় বছরে তার জন্ম। নবুয়াতের ষষ্ঠ বছরে হযরত উমার যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন আব্দুল্লাহর বয়স প্রায় পাঁচ।

হযরত ইবন উমার (রা) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে এমন সব কাজ থেকে সব সময় বিরত থাকতেন। তিনি ছিলেন সত্যভাষী। তবে মাঝে মাঝে মুসলিম উম্মাহর ক্ষতির সম্ভাবনা দেখলে চুপ থাকতেন। একবার হযরত আমীর মুয়াবিয়া (রা) দাবী করলেন খিলাফত লাভের অধিকার আমার থেকে বেশী আর কার আছে? ইবন উমার একথার জবাব দিতে গিয়েও ফিতনা-ফাসাদের ভয়ে দেননি। তিনি চুপ থাকেন।

এমনিভাবে মিনায় খলীফা উসমানের পেছনে চার রাকায়াত নামায আদায় করেন। অথচ তিনি মনে করতেন রাসূলুল্লাহ (সা), আবু বকর ও উমারের সুন্নাত অনুযায়ী সেখানে কসর হওয়া উচিত। আবার একাকী পড়লে দু’রাকায়াতই পড়লেন। বিভেদ সৃষ্টির আশংকায় উসমানের পেছনে চার রাকায়াত পড়েছিলেন।

তিনি বলতেন, “বিভেদ সৃষ্টি করা খারাপ কাজ”। তিনি আরো বলতেন, “সমগ্র উম্মাতে মুহাম্মাদী যদি আমাকে খলীফা বলে মেনে নেয় এবং মাত্র দু’ব্যক্তি মানতে অস্বীকার করে তবুও আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো না।”

বিভেদ সৃষ্টির ভয়েই তিনি সকল খলীফার হাতে বাইয়াত করেছিলেন। সেই ফিতনা-ফাসাদের যুগে তিনি সব আমীরের পেছনে নামায আদায় করতেন এবং তাদের হাতে যাকাত তুলে দিতেন। তবে এ আনুগত্য দ্বীনের সীমার মধ্যে সীমিত থাকতো। এ কারণে প্রথমে হাজ্জাজের পেছনে নামায আদায় করলেও পরে হাজ্জাজ নামাযে বিলম্ব করতে শুরু করলে তিনি তার পেছনে নামায আদায় ছেড়ে দেন। এমন কি মক্কা ছেড়ে মদীনায় চলে যান।

সত্য কথা বলতে ইবনে উমার কখনো ভয় পেতেন না। উমাইয়্যা বংশীয় শাসকদের সামনাসামনি সমালোচনা করতেন। একবার হাজ্জাজ খুতবা দিচ্ছিলেন। ইবন ইমার তাকে লক্ষ্য করে বললেনঃ “এই লোকটি আল্লাহর দুশমন। সে মক্কার হারামের অবমাননা করেছে, বাইতুল্লাহ ধ্বংস করেছে এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের হত্যা করেছে।”

বিনয় ও নম্রতা তাঁর চরিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। নিজের প্রশংসা শুনতে তিনি ভীষণ অপছন্দ করতেন। এক ব্যক্তি তার প্রশংসা করছিল। তিনি তার মুখে মাটি ছুঁড়ে মারলেন। অতঃপর তাকে রাসূলুল্লাহর (সা) এ হাদীস — প্রশংসাকারীর মুখে মাটি ছুঁড়ে মারো — শুনিয়ে দিলেন। কোন বাছ-বিচার না করে ছোট বড় সকলকে সালাম করতেন। পথ চলতে কোন ব্যক্তিকে সালাম করতে ভুলে গেলে ফিরে এসে তাকে সালাম করে যেতেন। অত্যন্ত কটু কথা শুনেও হজম করে যেতেন, কোন জবাব দিতেন না। এক ব্যক্তি কটু ভাষায় তাকে গালি দিল। জবাবে তিনি শুধু বললেন, আমি ও আমার ভাই অত্যন্ত উঁচু বংশের। এতটুকু বলে চুপ থাকলেন।

ইবনে উমারের জীবনীতে আমরা দেখতে পাই, তাঁর আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত স্বচ্ছল ছিল। হাজার হাজার দিরহাম একই বৈঠকে ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কিন্ত তার নিজের ঘরের আসবাবপত্রের মোট মূল্য একশ দিরহামের বেশি ছিলনা। মায়মূন ইবন মাহরান বলেন, “আমি ইবন উমারের ঘরে প্রবেশ করে লেপ, তোষক, বিছানাপত্র ইত্যাদির দাম হিসাব করলাম। সব মিলিয়ে একশ দিরহামের বেশি হলনা।” তিনি এমনই সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। নিজের কাজ তিনি নিজ হাতে করতেন। নিজের কাজে অন্য কারো সাহায্য গ্রহণ তাঁর মনঃপুত ছিলনা।

হযরত উমারের যুগে যখন সকল সাহাবীর ভাতা নির্ধারিত হয়, তখন ইবনে উমারের ভাতা নির্ধারিত হয় আড়াই হাজার দিরহাম। পক্ষান্তরে উসামা ইবন যায়িদের ভাতা নির্ধারিত হয় তিন হাজার দিরহাম। ইবন উমার পিতা উমার (রা) -এর নিকট এ বৈষম্যের প্রতিবাদ করে বলেন, কোন ক্ষেত্রেই যখন আমি তার থেকে এবং আপনি তার পিতা থেকে পিছিয়ে নেই, তখন এই বৈষম্যের কারণ কি?

উমার (রা) বলেন, সত্যই বলেছ। তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পিতাকে তোমার পিতা থেকে এবং তাঁকে তোমার থেকে বেশি ভালোবাসতেন। জবাব শুনে ইবন উমার (রা) চুপ হয়ে যান।

জনৈক তাবিঈন তার সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, “আমি যদি কোন ব্যক্তির জন্য সাক্ষ্য দিতাম যে সে জান্নাতের অধিবাসী, তাহলে অবশ্যই ইবন উমারের জন্য দিতাম।”

▲ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা (দ্বিতীয় খন্ড) থেকে মূল জীবনীর অংশবিশেষ হুবহু উদ্ধৃত ▲

1 Comments

Post a Comment