ইমাম ইবন তাইমিয়া- জেল জুলুম যাকে দমাতে পারেনি


৬৯৩ হিজরীতে এক ঈসায়ীর ব্যাপারে এক অপ্রীতিকর ঘটনার কারনে তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এ সময় আসসাফ নামক এক ঈসায়ী সম্পর্কে লোকেরা সাক্ষ্য দেয় যে, সে রাসুল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে অশোভন বাক্য উচ্চারন করেছে। এ অন্যায় কাজ করার পর সেই ঈসায়ী জনৈক ইবন আহমাদ নামক এক আরবী ব্যক্তির কাছে আশ্রয় নেয়। এ কথা জানার পর ইবন তাইমিয়া দারুল হাদিসের শাইখ যায়নুদ্দিন আল-ফারুকি গভর্নর ইযযুদ্দিন আইউবীর কাছে গিয়ে ঘটনার তদন্ত করে অপরাধীর শাস্তি দাবী করেন। গভর্নর অপরাধীকে ডেকে পাঠান। লোকেরা আসসাফের সাথে একজন আরবীকে আসতে দেখে আরবীটিকে গালিগালাজ করতে থাকে। আরবীটি বলে যে, এ ঈসায়ী তোমাদের চেয়ে ভালো। এ কথা শুনে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে তাদেরকে ঢিল মারতে থাকে। মুহূর্তের মধ্যে বিরাট হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়। গভর্নর এ জন্য ইবন তাইমিয়া ও তাঁর সাথীদেরকে দায়ী মনে করে তাদেরকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। ঘটনার আকস্মিকতায় ও নাটকীয় পট পরিবর্তনে প্রভাবিত হয়ে ঈসায়ীটি ইসলাম গ্রহন করে। গভর্নর তাঁর প্রানের নিরাপত্তা বিধান করেন। পড়ে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ইমাম ইবন তাইমিয়া ও তাঁর সাথীকে কারামুক্ত করেন। এরফলে ইবন তাইমিয়ার জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে যায়।

৭০৫ হিজরী ১৩০৬ সালে ইবন তাইমিয়া শাফেয়ী কাজীর সাথে কায়রো গমন করেন। সেখানে তিনি আল্লাহর প্রতি মানবীয় গুন আরোপ করার জন্য সুলতান কর্তৃক অভিযুক্ত হন। বিচারক ও সম্ভ্রান্ত পরিষদে পাঁচটি অধিবেশনের পর দু’ই ভাইসহ তিনি একটি পার্বত্য দুর্গের ভু-গর্ভস্থ কারাগারে বন্দী হন। সেখানে তাকে দেড় বছর আটক রাখা হয়।

৭০৭ হিজরীতে 'ইত্তেহাদিয়া' দলের বিরুদ্ধে লিখিত তাঁর একটি পুস্তক সমন্ধে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি নিজ মতের সমর্থনে যে প্রমান উপস্থিত করেন, তাতে তাঁর বিরোধীরা একেবারে নিরুত্তর হয়ে যায়। ফলে দামেশকে প্রত্যাবর্তনের শর্তে তিনি মুক্তি লাভ করেন। তিনি দামেশকের পথে একটি মাত্র মানযিল অতিক্রম করার পর তাঁকে বলপূর্বক কায়রোতে ফেরত এনে রাজনৈতিক কারনে ‘হাররা আদ-দায়লাম’ –এ কাজীর কারাগারে আরও দেড় বছর আটক করে রাখা হয়। তিনি এ সময় কারারুদ্ধ ব্যক্তিদেরকে ইসলামের নীতি আদর্শ শিক্ষাদানে ব্যায় করেন। তারপর অল্প কয়েকদিন স্বাধীনতা ভোগের পর তাঁকে আট মাস আলেকজান্দ্রিয়ার দুর্গে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়।

৭১৮ হিজরীতে সুলতান তাঁকে তালাক এর ‘হালাফ’ সম্পর্কে ফতওয়া দিতে নিষেধ করেন। ‘হালাফ বিত তালাক’ হল এরুপ শপথ করা যে, ‘আমি অবশ্যই এমনটি করবো- অন্যথায় আমার স্ত্রী তালাক হয়ে যাবে’। ইবন তাইমিয়া এটাকে নিছক একটি শপথ বা অঙ্গীকার মনে করতেন। এর ফলে স্ত্রী তালাক হবে না বলে ফতওয়া দেন। এই প্রশ্নে তাঁর মত অপর তিনটি ফিকহী মাযহাবের ফকীহরা স্বীকার করেন না। তাঁর মতে, যে ব্যক্তি এরুপ ‘হালাফ’ করে সে বিবাহের চুক্তি পালনে বাধ্য থাকবে। তবে কাজী তাকে নিজ বিবেচনা অনুযায়ী শাস্তি দিতে পারেন। তিনি সুলতানের এ নিষেধাজ্ঞা পালনে অস্বীকার করেন। এ কারনে ৭২০ হিজরীতে সুলতান তাকে দামেশকের দুর্গে আবদ্ধ করেন। ৫ মাস ১৮ দিন পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়।

মিশরের কারাগারে থাকা অবস্থায় তিনি দেখতে পান যে, কয়েদীরা নিজেদের চিত্ত বিনোদনের জন্য নানা রকম আজেবাজে খেলাধুলায় মত্ত হয়ে পরেছে। কেউ তাস, কেউ দাবা খেলায় মশগুল। নামাজের দিকে তাদের কোন খেয়াল নেই। নামাজ কাজা হয়ে যাচ্ছে খেলার ঝোঁকে। ইমাম ইবন তাইমিয়া এতে আপত্তি জানান। তিনি কয়েদীদেরকে নামাজের প্রতি আকৃষ্ট করেন। আল্লাহর প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশগুলো সম্পর্কে তাদেরকে সজাগ করেন এবং এসবের জন্য তাদেরকে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করার উপদেশ দেন।

এভাবে কিছুদিনের মধ্যে জেলখানার কয়েদীদের মাঝে দীনী ইলমের এমন চর্চা শুরু হয়ে গেল যে, সমগ্র কারাগারটিই একটি মাদ্রাসায় পরিনত হয়ে গেল। কারাগারের কর্মচারী ও কয়েদীরা ইমাম ইবন তাইমিয়াকে মনেপ্রানে ভালোবেসে ফেললো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে, এ সময় অনেক কয়েদী তাদের কারামুক্তির ঘোষণা শুনার পরও জেলখানা ছেড়ে যেতে চাইত না। তারা ইমাম ইবন তাইমিয়ার কাছে আরও কিছুদিন থেকে যেতে আর্জি পেশ করতো।

৭২৬ হিজরীতে তাঁর শত্রুরা দরবেশ ও নবীদের কবর যিয়ারত এর উদ্যেশ্যে সফর করা নিষেধ সম্পর্কে ৭১০ হিজরীতে প্রদত্ত তাঁর ফতওয়ার কারনে তাকে অভিযুক্ত করে দামেশকের দুর্গে তাঁর অন্তরীনের ব্যবস্থা করে। তাকে কারাগারে একটি স্বতন্ত্র কক্ষ দেয়া হয়। তাঁর নিরাপরাধ ভ্রাতা শারফুদ্দিন আব্দুর রাহমান তাঁর সাথে স্বেচ্ছায় কারাগারে বাস করতে থাকেন।

কারাবাসের সময় তাঁর সাহায্যে ইবন তাইমিয়া ‘আল বাহারুল মুহীত’ নামে আল-কুরআনের একখানি তাফসীর, তাঁর প্রতিপক্ষের মতবাদের জওয়াব এবং যেসব অভিযোগে তাঁর কারাদণ্ড হয়, সে সব বিষয়ে পুস্তকাদি রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর শত্রুরা পুস্তক রচনার কথা জানতে পেরে তাঁকে লিখন উপাদান হতে বঞ্চিত করে। এটি ছিল তাঁর প্রতি চরম আঘাত।

এরপর তিনি সলাত ও কুরআন পাঠের মাধ্যমে শান্তি লাভের চেষ্টা করেন। অবশেষে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ২০ দিন পর ৭২৮ হিজরীর ২০ যুলকাদা ১৩২৮ সালের ২৭ শে সেপ্টেম্বর রবি ও সোমবারের মধ্যবর্তী রাতে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন)

মহান আল্লাহ ইসলামের এই মহান ব্যক্তি, বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন সৈনিক ইমাম ইবন তাইমিয়াকে তাঁর ভুলত্রুটি ক্ষমা করে তাঁকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন।

সুত্রঃ- ইমাম ইবন তাইমিয়া (রহঃ) জীবন ও কর্ম- অধ্যক্ষ এ, কিউ, এম আবদুল হাকিম আল মাদানী ও ড. মুহাম্মাদ আব্দুস সামাদ গবেষণা বিভাগ- বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ঢাকা। গবেষণাপত্র সংকলন-৫

Post a Comment